আলো ঝলমলে মঞ্চের সঙ্গে কখনোই অপরিচিত ছিলেন না থমাস রাইট 'ফ্যাটস' ওয়ালার। ১৯০৪ সালের ২১ মে নিউইয়র্কের হার্লেমে তার জন্ম। ধীরে ধীরে তিনি জ্যাজ ও সুইং যুগের এক বিশাল নাম হয়ে ওঠেন। তার পরিবেশনা ছিল বিদ্যুৎঝলমলে। পিয়ানো বাজানোর ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। হার্লেম স্ট্রাইড পিয়ানো ধারায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
'এইন্ট মিসবিহেভিন', 'আই'ম ক্রেইজি অ্যাবাউট মাই বেবি', 'হানিসাকল রোজ', 'টু স্লিপি পিপল', 'দ্য জিটারবাগ ওয়াল্টজ'—এই গানগুলো আজও শ্রোতাদের কাছে অমর। এসব সৃষ্টির জন্য তিনি জায়গা করে নেন গ্র্যামি হল অব ফেমে।
তবে ফ্যাটস ওয়ালারের জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর গল্পগুলোর একটি কোনো জ্যাজ ক্লাব বা ব্রডওয়ের মঞ্চে ঘটেনি। সেই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের একজন—আল কাপোন।
১৯২০ ও ৩০-এর দশকে ফ্যাটস ওয়ালার ছিলেন শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাদের একজন। তিনি ছিলেন জন্মগত পারফরমার। পিয়ানো বাজানোর পাশাপাশি তার ছিল অসাধারণ হাস্যরস। গল্প বলার ভঙ্গিতে থাকত খানিকটা দুষ্টুমি, খানিকটা সাহস। ব্যক্তিত্ব ছিল পুরোপুরি জীবনমুখী।
হার্লেম স্ট্রাইড পিয়ানোতে তার দখল ছিল অভাবনীয়। বাঁ হাতের শক্ত ছন্দ আর ডান হাতের ঝরঝরে সুর মিলিয়ে তার বাজনা শুনলে মনে হতো—যেন একাই পুরো একটি অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছেন। ঠিক এই কারণেই, যখন আল কাপোনের লোকেরা এক বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য একজন তারকা পারফরমার খুঁজছিল, তাদের পছন্দ গিয়ে ঠেকল ফ্যাটস ওয়ালারের নামেই।
এক রাতে শিকাগোর শেরম্যান হাউসে অনুষ্ঠান শেষ করছিলেন ফ্যাটস ওয়ালার। এই হোটেলটি ছিল উচ্চবিত্ত অতিথি ও গ্যাংস্টারদের আড্ডাখানা হিসেবে পরিচিত। শেষ সেটের পর তিনি বের হচ্ছিলেন।
ঠিক তখনই চারজন লোক তার পথ আটকে দাঁড়ায়। তাদের একজন তার পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বলে, 'কোনো নাটক তৈরি করবেন না। আমাদের সঙ্গে আসুন। সব ঠিক থাকবে।'
১৯৩০-এর দশকের আমেরিকায় এই দৃশ্য ছিল যেকারও জন্য ভয়ের। আর একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য তা ছিল আরও ভয়াবহ। ফ্যাটস ওয়ালার আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যান। তাকে প্রায় জোর করেই একটি লিমুজিনে তোলা হয়। গাড়ি চলতে শুরু করে। তার মাথায় তখন ঘুরতে থাকে নানা আশঙ্কা। এই বুঝি কোনো অন্ধকার জায়গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হবে।
কিন্তু গাড়িটি যায় অন্যদিকে। গন্তব্য ইলিনয়ের সিসেরো শহর। সেখানে অবস্থিত হথর্ন ইন—আল কাপোনের সদর দপ্তর।
হথর্ন ইন-এ পৌঁছে ফ্যাটস ওয়ালারকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ব্যক্তিগত কক্ষে। ঘরের ভেতরে উপস্থিত আল কাপোনের ঘনিষ্ঠ মহল। চারদিকে শিকাগোর অপরাধ জগতের পরিচিত মুখ। কিছুক্ষণ পরেই কারণটি পরিষ্কার হয়। সেদিন ছিল বিগ আলের (আল কাপোনের ডাক নাম) জন্মদিন।
ফ্যাটস ওয়ালার ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের সারপ্রাইজ। কাপোন তাকে দেখেই আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ভীত-সন্ত্রস্ত পিয়ানোবাদককে সরাসরি পিয়ানোর সামনে বসতে বলা হয়।
ওয়ালার তখন বুঝতে পারেন—এই মুহূর্তে নিজের জীবন হয়তো তার পিয়ানোয় চালানো আঙুলের ওপরেই নির্ভর করছে। তিনি বসে পড়েন। বাজাতে শুরু করেন।
ঘরে উপস্থিত অপরাধ জগতের অভিজাতরা নীরবে শুনতে থাকে। ফ্যাটস ওয়ালারের সুর ধীরে ধীরে ঘরের আবহ বদলে দেয়। অস্ত্র, ভয় আর অপরাধের মাঝেও সংগীত নিজের জায়গা করে নেয়।
আল কাপোনের সঙ্গে এই অদ্ভুত সাক্ষাৎ ফ্যাটস ওয়ালারের কিংবদন্তি উপমাকে আরও রঙিন করে তোলে। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। হাস্যরস ছিল তার স্বভাবজাত। তার অমায়িক ব্যবহার ও সারল্যে অভিভূত কাপোন তাকে প্রচুর পরিমাণ খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন। ওয়ালারের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও তাকে গানপ্রতি ১০০ ডলার পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। অপহরণকারীদের দিয়ে নিরাপদে ওয়ালারকে তার গন্তব্যেও পৌঁছে দেন বিগ আল।
গ্যাংস্টারভরা ঘরেও ফ্যাটস ওয়ালার প্রাণের আলো ছড়াতে পেরেছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও গীতিকার অ্যান্ডি রাজাফ একবার তাকে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন—'সে ছিল আনন্দে ভরা এক বুদবুদ, যে পিয়ানোকে এমনভাবে গান গাওয়াতে পারত, যেমন আর কেউ পারত না।'
দুঃখজনক বিষয় হলো—১৯৪৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফ্যাটস ওয়ালারের মৃত্যু হয়। কিন্তু তার সংগীত হারিয়ে যায়নি। তাকে ঘিরে থাকা গল্পগুলোও মুছে যায়নি।
আল কাপোনের হাতে তার 'অপহরণ'-এর কাহিনি আজও মানুষকে বিস্মিত করে। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের সেই অদ্ভুত মুহূর্তগুলোর কথা, যেখানে শিল্প আর ক্ষমতার পথের সাক্ষাৎ হয়। যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধীরাও স্তব্ধ হয়ে যায় এক শিল্পীর সুরের সামনে।
আজ ফ্যাটস ওয়ালারের উত্তরাধিকার বেঁচে আছে তার কালজয়ী সৃষ্টিতে, গল্পে। বেঁচে আছে একজন জ্যাজ কিংবদন্তির জীবনের সেই অবিশ্বাস্য অধ্যায়ে, যেখানে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতেও তিনি অপরাধী-সন্ত্রাসীদের মনে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
পাঠকের মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য (১)
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!